Wednesday, August 16, 2017

হাতেম তাইয়ের দানশীলতা

হযরত সায়্যিদুনা মিলহান তায়ী (রাঃ) থেকে বর্ণিত: হাতেম তাইয়ের স্ত্রী তার দানশীলতার একটি ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: একদা সারা দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলো। ঐ সময় একেবারে শষ্য উৎপাদন হয়নি, আসমান থেকে সারা বৎসর বৃষ্টিপাত হয়নি। উটগুলো সারা দিন পানির সন্ধানে ঘুরাঘুরি করতঃ কিন্তু একটি ফোটা পানিও তাদের নসীব হতো না। প্রত্যেক প্রাণী ক্ষুধা এবং পিপাসায় অস্থির ছিলো। এক রাতে বেশি পরিমাণে ঠান্ডা পড়েছিলো এবং আমার ঘরে খাওয়ার প্রতিবেশীর হক  ৪ জন্য একটি লোকমা খাবারও ছিলো না। আমাদের সন্তান আব্দুল্লাহ্, আদী এবং (একমাত্র কন্যা) সিফ্ফানা ক্ষুধায় ছটফট করছিলো। অবশেষে দীর্ঘ রাত অতিবাহিত হওয়ার পর ক্লান্ত হয়ে দুই ছেলে ঘুমিয়ে পড়লো, আমি তাদেরকে একটি চাটাইয়ে শুয়ায়ে দিলাম। অতঃপর তৃতীয় জনকে ভুলাতে লাগলাম অবশেষে সেও ঘুমিয়ে পড়লো। হাতেম তাই বললো: আজ আমি জানি না আমার কেন ঘুম আসছে না? অতঃপর তিনি এদিক সেদিক টহল দিতে লাগলো। হঠাৎ আমাদের ঘরের বাহিরে কারও আওয়াজ শুনা গেলো। হাতেম তাই উচ্চ আওয়াজে বললো: কে? কিন্তু কেউ উত্তর দেয়নি। আমি বাহিরে গেলাম এবং অবস্থার খবরাখবর নিয়ে ফিরে আসলাম এবং হাতেম তাইকে বললাম: আপনার অমুক প্রতিবেশীনী। এই কঠিন সময়ে আপনি ছাড়া অন্য কেউ তার দৃষ্টিতে পড়েনি, যার কাছে সে আশ্রয় নিবে। নিজের ক্ষুধার্ত বাচ্চাকে আপনার কাছে এনেছে। তার ক্ষুধায় এমনভাবে ছটফট করছে যেমন কোন প্রাণীর বাচ্চা চিৎকার করে থাকে। এটা শুনে হাতেম তাই বললো: তাদেরকে তাড়াতাড়ি আমার কাছে নিয়ে আসো, আমি বললাম: আমাদের নিজেদের সন্তান ক্ষুধায় মরছে, তাদেরকে দেয়ার জন্য আমাদের কাছে কোন কিছু নেই, আর অমুক প্রতিবেশী এবং তাদের সন্তানকে আমরা কিভাবে সাহায্য করবো? হাতেম তাই বললো: চুপ থাকো! আল্লাহ্ তায়ালা অবশ্যই তোমাদের এবং তাদের সকলের পেট ভর্তি করে দিবেন। যাও! তাড়াতাড়ি সেই দুঃখী মাকে ভিতরে ডেকে নিয়ে আসো। আমি তাকে ডেকে নিয়ে আসলাম। সেই গরীব মহিলা দুইটি সন্তান তার কোলের মধ্যে উঠানো ছিলো এবং ৪টি সন্তান তার পিছনে আসছিলো। হাতেম তাই তাদেরকে কক্ষের মধ্যে বসালেন এবং নিজের একটি মোটাতাজা প্রাণী যবেহ করে আগুন জ্বালালেন, যখন আগুনের শিখা উঠতে লাগলো, তখন ছুরি নিয়ে সেটার চামড়া তুলে ফেললো। অতঃপর ঐ মহিলার দিকে ছুরি বাড়িয়ে বললো: খাও! এবং নিজের সন্তানদেরকেও খাওয়াও, অতঃপর আমাকে বললো: তুমিও খাও এবং সন্তানদেরকেও জাগ্রত করে দাও, যেন তারাও তাদের ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে। আমাদের প্রতিবেশীনী অল্প অল্প করে মাংস খাচ্ছিলো, তার সংকোচ বোধ লক্ষ্য করে হাতেম তাই বললো: কতই মন্দ কথা যে, তোমরা আমাদের মেহমান হয়ে অল্প অল্প করে খাচ্ছো। এটা বলে সে আমাদের কাছে টহল দিতে লাগলো, আমরা সবাই ৫ খাবারের মধ্যে ব্যস্ত ছিলাম এবং হাতেম তাই আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলো এবং আমরা খুব তৃপ্তি সহকারে খেয়েছি। কিন্তু আল্লাহ্ তায়ালার শপথ! হাতেম তাই একটি মাংসের টুকরা পর্যন্ত খায়নি। অথচ তিনি আমাদের সবার চেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত ছিলেন। সকালে জমিনে হাড্ডি এবং পায়ের গোড়ালি ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিলো না।
(উয়ুনূল হিকায়াত, ২/২৪০, সারাংশ)

প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! বর্ণিত উপদেশ মূলক ঘটনা থেকে কয়েকটি মাদানী ফুল আমাদের জানা হয়ে গেছে, উদাহরণস্বরূপ:- পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে প্রতিবেশীর মঙ্গল কামনা এবং তাদের কষ্টের অনুভূতি কি পরিমাণ ভরা ছিলো। হাতেম তাই যাকে জাহেলী যুগে দানশীলতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রসিদ্ধ মনে করা হতো। বিশেষ করে তার প্রতিবেশীদের উপর অনেক দয়ালু ছিলো। তার সত্যিকারের মঙ্গল কামনা এবং অভাবী প্রতিবেশীদের তিনি আশ্রয়স্থল ছিলো। যখন তার প্রতিবেশীর মধ্যে কেউ কষ্টে পতিত হতো, তখন তার রাতের ঘুম চলে যেতো এবং তার উপর ব্যাকুল অবস্থা জারী হতো। এই ঘটনা দ্বারা বুঝা গেলো, প্রতিবেশীদের সাথে উত্তম আচরণ করা প্রাচীন যুগ হতে মানুষের মধ্যে প্রচলিত ছিলো। অতঃপর যখন ইসলামের সূর্য উদিত হলো, তখন এই আন্তর্জাতিক ধর্ম এবং বান্দার অধিকারের সবচেয়ে বড় পতাকাধারী ধর্ম প্রতিবেশীর অধিকার সমূহের গুরুত্ব আরো অনেক বাড়িয়ে দিলো। অতএব ইসলাম ধর্মের জন্য প্রাণ উৎসর্গকারীরা, আল্লাহ্ তায়ালার বিধিবিধানের সামনে মাথা নতকারীরা, মুস্তফা জানে রহমত, হুযুর (স‌াঃ)এর আশিকগণ তাদের কথাবার্তা, কাজ-কর্মের মাধ্যমে প্রতিবেশীর অধিকার আদায় করা এবং তাদের সাথে উত্তম আচরণ করার সেই মহান উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছেন যে, যাদের দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসের মধ্যে পাওয়া কঠিন।  আসুন! উৎসাহ গ্রহণার্থে প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণের উপর একটি ঈমান তাজাকারী ঘটনা শুনে নিই এবং উপদেশের মাদানী ফুল গ্রহণ করি; যেমনিভাবে-
একজন প্রতিবেশীর তাওবা  হযরত সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ্ বিন রজাআ  (রাঃ) বলেন: কুফায় ইমাম আযম আবু হানীফা (রাঃ) এর প্রতিবেশীর মধ্যে একজন মুচী থাকতো। যে সারা দিন পরিশ্রম করতো এবং রাতে ঘরের মধ্যে মাছ অথবা (কোন প্রাণীর) মাংস নিয়ে আসতো, অতঃপর সেগুলো বুনে খেতো। এর পর মদ পান করতো। যখন মদের নেশায় মাতাল হয়ে যেতো, তখন খুব চিৎকার করতো। এভাবে গভীর রাত পর্যন্ত এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকতো, এমন কি তার ঘুম চলে আসতো। কোটি কোটি হানাফীদের মহান ইমাম হযরত সায়্যিদুনা ইমাম আযম আবু হানীফ  (রাঃ) এর সেই চিৎকারের কারণে সীমাহীন কষ্ট হতো। কিন্তু তিনি সারারাত নামাযের মধ্যে ব্যস্ত থাকতেন। এক রাতে সেই প্রতিবেশী মুচীর আওয়াজ শুনেন নাই, সকাল বেলা তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন, তখন তাঁকে বলা হলো; রাতে সিপাহীরা তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে আর সে জেলখানায়। ইমাম আযম (রাঃ) ফজরের নামায আদায় করলেন এবং তাঁর বাহনের উপর আরোহণ করে খলীফার কাছে গেলেন, আর নিজের আসার খবরটা খলীফার কাছে পাঠালেন। খলীফা হুকুম দিলেন, তাঁর বাহনের লাগাম ধরে অত্যন্ত সম্মানের সাথে শাহী গালিচা পর্যন্ত নিয়ে আসো এবং তাঁকে বাহন হতে অবতরণ করতে দিবে না। সিপাহীরা সেভাবেই করলো। খলীফা জিজ্ঞাসা করলো: কি হুকুম? তিনি বললেন: আমার একজন প্রতিবেশী মুচী ছিলো, যাকে গত রাতে সিপাহীরা গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছে, তার মুক্তির হুকুম দিন। খলীফা আদেশ জারী করলো যে, ঐ মুচীকে তাড়াতাড়ি মুক্ত করে দাও এবং ঐসব কয়েদীদেরকেও মুক্ত করে দাও যাদেরকে আজকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। অতএব সকলকে মুক্ত করে দেয়া হলো।  অতঃপর ইমাম আযম (রাঃ) বাহনের উপর আরোহণ করে পথ চলা শুরু করলেন। সেই প্রতিবেশী তাঁর পিছনে পিছনে চলতে লাগলো, তখন ইমাম আযম (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন: হে যুবক! আমি কি তোমাকে কোন কষ্ট দিয়েছি? সে আরয করলো: না বরং আপনি আমাকে সাহায্য করেছেন এবং আমার জন্য সুপারিশ করেছেন। আল্লাহ্ তায়ালা আপনাকে এর উত্তম প্রতিদান দান করুক। কেননা, আপনি প্রতিবেশীর সম্মান এবং অধিকারকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এর পরে সেই ব্যক্তি তাওবা করে নিলো এবং গুনাহ থেকে ফিরে আসলো।  (মানাকিবে ইমাম আযম, ২২৪,২২৫ পৃষ্ঠা) 

0 comments:

Post a Comment

Share

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More